Powered By Blogger

১৬ জুন ২০১৬

দমনে দৃঢ় রাষ্ট্র কাঠামো

সরকারি দরকার না মানা নাগরিকরা মূলত ‘রাষ্ট্রীয় বখাটে’। আর এ সংজ্ঞা পৃথিবীর সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য বলা চলে। প্রত্যেক রাষ্ট্রই বখাটে দমনে সদা বদ্ধ পরিকর।  এই যেমন ধরুন, আমাদের দেশে তারহীন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের পরিচয় নিশ্চিতে সরকার নির্দেশিত আঙুলের ছাপ বা টিপসই সংগ্রহের অভিযানে অংশ নেননি যে নাগরিকরা; তারাও এখন ‘রাষ্ট্রীয় বখাটে’ হিসেবে চিহ্নিত। ইতোমধ্যে তাদের ‘সাইজ’ করাও হয়ে গেছে। এক রাতের মধ্যে কোমায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের কথাযন্ত্রগুলোর আড়াই কোটি হৃদয় (সিম)।

ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল, ৩১ মে দিবাগত রাতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বর্তমানে সারাদেশেই তোলপাড় চলছে। মূলধারা গণমাধ্যম ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বিভিন্ন মানুষের নানান মত প্রকাশিত হচ্ছে। বাদ দেই সে আলাপ।
আমাদের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতারক্ষার অধিকার থাকবে।’ তবে তা অবশ্যই ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’ মেনে। অর্থাৎ কমপক্ষে চারটি অজুহাতে আপনার যোগাযোগ মাধ্যমের গোপনীয়তা খর্বের অধিকার বাংলাদেশ সরকারের আছে। আদতে ধরার তামাম রাষ্ট্রনীতি প্রাণের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
আদতে ধরার তামাম রাষ্ট্রনীতি প্রাণের স্বাধীনতার পরিপন্থী। তাদের পিতা – ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ মূলত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের ফাঁদে বন্দী। প্রাণীকূলের অন্য কোনো পশুপাখিকে তা তোয়াক্কাও করে না। তারাও অবশ্য পাত্তা দেয় না মেরুদণ্ড সোজা করে চলা দো পেয়ে জীবদের কোনো নিয়ম-কানুন। হয়ত ভয় পায় কিছুটা। কারণ মহাপ্রকৃতির সকল প্রাণই জানে, মানুষ নামক এ প্রাণীর চেয়ে হিংস্র কোনো জীব দুনিয়াতে অন্তত নেই। তার ওপরে এদের হিংস্রতা আবার ক্রমবর্ধমান।

অতীতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের আক্রোশে এরা নিজেদেরও বিলীন করেছে বহুবার। অন্যান্য প্রাণীদের জিনেও নিশ্চয়ই লেখা রয়েছে সেই নৃশংস ইতিহাস। বস্তুত মনুষ্যকূলের পোশাক ঢাকা শরীরের নাজুকতা, অন্তরের কঠোরতাকে আড়াল করতে পারে না। স্বভাবগত ঐতিহাসিকতার কারণেই তারা এমন। ব্যাতিক্রমও আছে। কারণ মানুষ বিচিত্রও বটে। বস্তুত মনুষ্যকূলের পোশাক ঢাকা শরীরের নাজুকতা, অন্তরের কঠোরতাকে আড়াল করতে পারে না।

মূল কথা হচ্ছে, নিজেকে নির্দিষ্ট সীমানায় ঘেরা একটি জনপদের মানুষ ভেবে দুনিয়াতে কেউ স্বাধীন ও মুক্তমনা হতে পারে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকই তা নন। প্রত্যেকেই নিয়ন্ত্রণাধীন। রাষ্ট্রগুলোর শাসক শ্রেণী আপনার, আমার নিয়ন্ত্রক। বাঙালের দেশে বসে এ বাস্তবতা বেশ প্রকটাকারেই টের পাচ্ছি আজ। তবে আশার কথা হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রীয় বখাটেরা এখনো কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ন্ত্রিত সংযুক্তির জালে তারা আটকে আছেন, সম্ভবত ব্যবসায়িক কারণে।

গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ আবার তাদের এক বার্তাও পাঠিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে- ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সকল অনিবন্ধিত সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার সংযোগ পুনরায় চালু করতে জিপি বায়োমেট্রিক পয়েন্টে চলে আসুন। চার্জ প্রযোজ্য নয়।’ ওদিকে সরকারি সংস্থার বরাত দিয়ে দেশের প্রভাবশালী একটি পত্রিকা বলছে – ‘বন্ধ হয়ে যাওয়া সিম আবার চালু করতে নতুন সিম কেনার নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। বর্তমানে বায়োমেট্রিক উপায়ে নতুন সিম কিনতে অপারেটরভেদে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দাম রাখা হয়। এর মধ্যে সরকার সিমকর হিসেবে পায় ১০০ টাকা।’

এখানে বলে রাখি, বায়োমেট্রিক পরীক্ষায় অংশ না নেয়ায় আমিও এখন রাষ্ট্র স্বীকৃত দুষ্ট নাগরিক, মুঠোফোন সংযোগ বিচ্যুত। ভুগছি আরো নানা শাস্তির শঙ্কায়। কারণ এটি এমনই এক জনপদ, যেখানে ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালও ভালো’ টাইপের কথাও প্রচলিত আছে।  বায়োমেট্রিক পরীক্ষায় অংশ না নেয়ায় আমিও এখন রাষ্ট্র স্বীকৃত দুষ্ট নাগরিক, মুঠোফোন সংযোগ বিচ্যুত।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান’ করা হয়েছে ঠিকই; তবে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত- অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ’ মেনে।
অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে এই রাষ্ট্র আমাদের চিন্তা আর বিবেকেরও নিয়ন্ত্রক। সংবিধানের একই অনুচ্ছেদ বলে শর্তসাপেক্ষে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের এবং ‘সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে রাখা হয়েছে বাধা-নিষেধ অমান্যকারী বা শর্তভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ। এই সুযোগের ফাঁক গলেই চিন্তা, বিবেক, ভাব ও কথা নিয়ন্ত্রণকারী তামাম নিয়ম-কানুন, আইন তৈরী হচ্ছে, বিরাজ করছে এ বঙ্গে। এই সুযোগের ফাঁক গলেই চিন্তা, বিবেক, ভাব ও কথা নিয়ন্ত্রণকারী তামাম নিয়ম-কানুন, আইন তৈরী হচ্ছে, বিরাজ করছে এ বঙ্গে।

সামান্য ইস্যুতে এত কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না সম্ভবত। যদিও জানি কোনো কিছুই সামান্য নয়। সামান্যেই অসামান্য নিহিত রয়। তবে আজকাল কখন যে গায়ে কোন সিল লেগে যায়, তা বোঝা দায়। এই লেখা পড়েই না আবার কেউ বলে ওঠে – ‘ব্যাটা বিএনপি-জামায়াতের দালাল নয়ত’। হয় না, এমনও হয়’তো। দমনে পোক্ত হয় রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো।

প্রথম প্রকাশঃ ১ জুন, ২০১৬
গণমাধ্যমঃ নিউজনেক্সটবিডি ডটকম
newsreel [সংবাদচিত্র]