Powered By Blogger
ট্রান্সজেন্ডার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ট্রান্সজেন্ডার লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

০৮ মার্চ ২০২২

ট্রান্সদের কি নারী ভাবেন নারীবাদীরা?

সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ
ঈষৎ সম্পাদনা করে শিরোনামে উল্লেখিত প্রশ্নটির মুখোমুখি হই গত ২৪ জানুয়ারি, সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে। তখন দেশের প্রথম ‘নন-বাইনারি বিউটি ব্লগার’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা রূপান্তরিত লিঙ্গের মানবী সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআকে জিম্মি করে যৌন নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘাঁটছি। এই ইস্যুতে দেশের নারীবাদমানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোর নিস্ক্রিয়তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাদকে আইনি পদক্ষেপ নিতে সহায়তাকারী ‘ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট’ হো চি মিন ইসলাম প্রশ্নটি তুলেছিলেন।
তাঁর ভাষ্যে, “এত সংগঠন, সংস্থা, নারীবাদী, মানবাধিকার কর্মী; তারা কি আমাদের মতো ‘ট্রান্সজেন্ডার নারীদের’ আদৌ নারী মনে করেন?” সাদের ঘটনায় তাদের জানিয়েও সহায়তা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সাদের সাথে এত বড় অন্যায়ের ঘটনায় কেউ একটি বিবৃতি দিয়েও প্রতিবাদ জানালো না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়নি।”
“তারা কিসের নারীবাদী, কিসের মানবাধিকার কর্মী?”- ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে এমন প্রশ্নও তোলেন হো চি মিন। সেদিনই এ ব্যাপারে জানতে চাই মুক্তিযোদ্ধা ও নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী রোকেয়া কবিরের কাছে। তিনি অকপটেই বললেন, “ট্রান্সজেন্ডারদের এই অভিযোগটা কিন্তু ঠিকই আছে, মিথ্যা নয়, অস্বীকারও করছি না। এটা আমাদের অক্ষমতা। আসলে এখানে এত বেশি ঘটনা ঘটছে যে, প্রতিটি ইস্যুতে সাধারণ নারীদের পাশেও অনেক সময় আমরা দাঁড়াতে পারি না। যদিও সাধারণ নারীদের চেয়েও তারা অনেক বেশি বঞ্চিত।” বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) এই নির্বাহী পরিচালক জানিয়েছিলেন, মহিলা পরিষদ ছাড়া দেশের প্রায় সবগুলো নারী সংগঠনই ছোট পরিসরে কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ ও লোকবলের সংকটের কারণেও তাদের নিষ্ক্রিয় থাকতে হয়।
ঘটনাটি মাথায় নিয়েই আজ (৮ মার্চ) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলোয় নারী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বাণী, বক্তব্য, বিশ্লেষণ আর মন্তব্যগুলো মনযোগ দিয়ে দেখলাম; বাদ দেইনি সামাজিক মাধ্যমগুলোও। ঢাকায় ‘নো পাসপোর্ট ভয়েস’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়া রূপান্তরিত নারীদের জন্য আর কোনো আয়োজন বা তাদের অধিকার সম্পর্কিত ভাষ্য পেলাম না।
তবে গত বছরের এই দিনে ‘রূপান্তরিত নারীদের পেছনে ফেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস নয়’ শিরোনামে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট্রের গবেষক শারমিন আকতার বলেছেন, “আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে দেশের সব নারীর পাশাপাশি এসব রূপান্তরিত নারীর অর্জনচিত্র বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হলে পরিবার ও সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।”

ধান ভানতে শিবের গীত

গাইতেই হচ্ছে, অর্থাৎ স্থানীয় সমাজে লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের অবস্থান সহজে বোঝাতে গত জানুয়ারির ঘটনায় ফিরতে হচ্ছে। ওই সময় রূপান্তরিত লিঙ্গের নারী পরিচয়ে ‘মামলা করার সুযোগ পেয়েই খুশি’ হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ঢাকায় বসবাসকারী ২২ বছর বয়সী সাদ মুআ। ভাটারা থানায় তাঁর দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের তিন সদস্যকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গ্রেফতার করায়ও তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। মুঠোফোনে দেওয়া সাক্ষাতকারে সাদ বলছিলেন, “র‌্যাব অভিযোগটি এত গুরুত্ব দেওয়ায় আমি নিজেই বেশ বিষ্মিত। তারা যতটা সম্মান দিয়ে আন্তরিকভাবে সব শুনেছেন ও বুঝেছেন তা-ও প্রশংসনীয়। আসলে আমি আশা করিনি, বাংলাদেশের কোনো নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে এমন আচরণ পাবো।”

সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ
র‌্যাব কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে আশ্বস্ত করায় এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় ‘খুবই সন্তুষ্ট’ সাদ বলেন, “প্রথমে আমি পুলিশের কাছে (ভাটারা থানায়) গিয়েছিলাম। তাদের আচার-ব্যবহারও ভালোই লেগেছে। কিন্তু তারা আসলে খুব একটা তৎপর হননি। যে কারণে আমি হতাশ ছিলাম। পরে র‌্যাবের কাছে যাই।” র‌্যাব সক্রিয় হওয়ার পরই ঘটনার মোড় ঘুরে যায় বলেও উল্লেখ করেন সাদ। সংস্থাটির দুটি ব্যাটালিয়ন ২২ জানুয়ারি রাত থেকে ২৩ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত ঢাকার ফার্মগেট ও মহাখালী এলাকায় যৌথ অভিযান চালায়। তারা ঘটনার মূলহোতা ফুয়াদ আমিন ইশতিয়াক ওরফে সানি (২১), সহযোগী সাইমা শিকদার নিরা ওরফে আরজে নিরা (২৩) ও আব্দুল্লাহ আফিফ সাদমান ওরফে রিশুকে (১৯) গ্রেফতার করে। ভাটারা থানায় ২১ জানুয়ারি সাদের দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতারের কথা জানিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতারকৃতরা ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। ইশতিয়াক এই চক্রের মূলহোতা এবং নীরা ও রিশু তার অন্যতম সহযোগী। তারা বিগত দুই বছর ধরে নানা কৌশলে মানুষকে জিম্মি ও প্রতারণা করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষদের অর্থ হাতিয়ে আসছিল। তারা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন জনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এরপর কৌশলে বিভিন্ন সময়ের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে তাদের ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে। তারা অপকর্মের জন্য নিজেদের ভাড়া নেওয়া বাসা ব্যবহার করতো। গত ১০ জানুয়ারি তাদের প্রতারণার জালে ফেঁসেছিলেন সাদ। এসব অপরাধ করার সময় তারা নিজেদেরকে সেনা কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে আসছিল বলেও জানায় র‌্যাব।

সর্বশেষ ২৪ জানুয়ারি দুপুরে ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুর রহমানের সাথে কথা হয়েছিল এ বিষয়ে। তিনি জানান তিনজনের মধ্যে শুধুমাত্র নীরাকে তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। “রোববারই তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে তিনদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। তবে আবেদন মঞ্জুর না করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন বিচারক,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগেই ‘ফেসবুক স্ট্যাটাসে’ নীরা দাবি করেছিলেন, তিনি পরিস্থিতির স্বীকার।

কেন ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ?

এ বিষয়ে হো চি মিন বলেছিলেন, “ঘটনাটি শুধু সাদের, মানে একজন ব্যক্তি মানুষের ঘটনা হলেও এখানে একটি বড় বিষয় হচ্ছে যে তিনি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। এটার সাথে পুরো বাংলাদেশের প্রান্তিক অবদমিত একটি সম্প্রদায় সংযুক্ত। গত ২১ তারিখে যে মামলাটি দায়ের হয়েছে, সেখানে সাদের পরিচয় লেখা আছে ‘ট্রান্সজেন্ডার নারী’। এটা বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য বড় একটি ঘটনা। এ ঘটনা পুরো সম্প্রদায়ের আইনি সহায়তা ও বিচারের পথ সুগম করবে।” তাঁর দাবি, বাংলাদেশের ইতিহাসে থানায় বা আদালতে এর আগে ‘ট্রান্সজেন্ডার নারী’ হিসেবে কেউ মামলা করেনি, এমন পরিচয়ে কারো মামলা নেয়া হয়নি। ওই সময় সাদ বলেছিলেন, “প্রথমত আমি নিজেও এরকম পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস পাইনি। তবে আমি অনেক মানুষকে আমি পাশে পেয়েছি, যার মধ্যে হো চি মিন একজন। সে-ই আমাকে সব কিছুতে সাহায্য করেছে।”

কাণ্ডারী হতে চান সাদ

বিউটি ব্লগার হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া সাদের ইউটিউবে ৫৭ লাখ ছয় হাজার, ইন্সটাগ্রামে ৩৩ লাখ আট হাজার এবং ফেসবুকে ২৪ লাখ হয় হাজার ফলোয়ার ছিল গত জানুয়ারিতেই, যা এখন হয়তো আরো বেড়েছে। তিনি বলছিলেন, “এই ‘ক্যারিয়ার বা জার্নি’ আমার জীবনকে একদম বদলে দিয়েছে। মনে হয় না, আমি যদি এখানে এই অবস্থানে না থাকতাম তবে আমি এত সহজে আইনি সহায়তা পেতাম। ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-য় অজস্র মানুষের ‘সাপোর্ট’ আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।”

সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ
সাদ মনে করেন, তাঁর এই কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় সমাজে হিজড়া সম্প্রদায়ের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তিনি বলেন, “আমার আসলে আরো আগানোর ইচ্ছে আছে। আমি আগামীতে মেয়েদের একটি ‘মেকাপ ব্র্যান্ড’ খুলতে চাই। আর আমার কমিউনিটির জন্যও কাজ করতে চাই। আমি চাই, আমার মতো যারা আছে, তারা যাতে আমার মাধ্যমে আরো সাবলম্বী ও শক্তিশালী হয়।। আমি চাই না আমার পরের প্রজন্মের ‘ট্রান্সজেন্ডার’-রা আমার মতো করে ‘সাফার’ করুক। আমি তাদের জন্য জীবনযাপনের পথটা একটু সহজ করে দিতে চাই।”

দেশের ‘ট্রান্সজেন্ডার কমিউটিনিটি’-ও সাদকে নিয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছিলেন হো চি মিন। তাছাড়া সাদকে ‘খ্যাতনামা বিউটি ব্লগার ট্রান্সজেন্ডার নারী’ ও ‘প্রতিষ্ঠিত কর্মজীবী’ উল্লেখ করে র‌্যাব কর্মকর্তা মঈনও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তিনি নিজ যোগ্যতা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে কর্মদক্ষতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।”

সাদ বিন রাবী ওরফে সাদ মুআ

newsreel [সংবাদচিত্র]