ফয়সাল আরেফিন দীপন |
‘ভয় পেও না, তবে সাবধান থেকো।’ - লেখার সুবাদে পাওয়া হুমকীর খবর জেনে ঠিক এভাবেই আমায় অভয় দিয়েছিলেন, গত আগস্টে । সর্বশেষ কথা হয়েছিলো দিন পনেরো আগে। জানতে চেয়েছিলাম - কেমন আছেন? তার জবাব ছিলো - ‘খুব বেশি খারাপ।’ পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম - কেন? শরীর মুষড়েছে, না মন? নাকি প্রকাশনীর অবস্থা? কোনো জবাব পাইনি আর। গত রাতে ঘরে ফিরেই মৃত্যুর খবর পেলাম তার। বিদায় শ্রদ্ধেয় ফয়সল আরেফিন দীপন। যদিও আপনাকে এভাবে বিদায় দিতে চাইছে না মন।
বঙগে ধর্মের দোহাই দিয়ে চলতে থাকা সিরিয়াল কিলিঙ এর সর্বশেষ শিকার প্রকাশনা সংস্থা ‘জাগৃতি’ - এর মালিক দীপন। পবিত্র জুম্মাবারের ঠিক পরদিন গতকাল (৩১ অক্টোবর) তিনি ছাড়াও জখমের শিকার হয়েছেন প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’ মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল। তারা দু’জনেই উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করেছিলেন। নিজ নিজ প্রকশনালয়েই খুন হন তারা। দুই জায়গাতেই হামলার পর কার্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে যায় খুনীরা। লালমাটিয়ায় টুটুলকে হত্যা করতে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকা দুই ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকেও দুষ্কৃতকারীরা কুপিয়ে দরজা বন্ধ করে রেখে যায়।
গত বছর কবি মিছিল খন্দকারকে সাথে নিয়ে গড়া প্রকাশনী কাদাখোঁচা চালুর ব্যাপারে যাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা ও সার্বক্ষণিক উৎসাহ পেয়েছি তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফয়সল আরেফিন দীপন। আমাদের সবগুলো গ্রন্থের পরিবেশক তারই প্রকাশনী। শাহাবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় দীপন ভাইয়ের পুরানো অফিসে গল্প করতে গিয়ে তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাথেও দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। জ্ঞানী এই মানুষটির সামনে এ দেশের মিডিয়া, মানুষ এখন কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াচ্ছে তা বুঝতেও ইচ্ছে করছে না।
ছেলে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ, হতাশ এই বাবা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না। চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’ এমন পিতার সন্তানের রক্ত বৃথা যাবে না নিশ্চয়ই। কারণ এই বাঙালরা রক্ত দিয়ে মুক্তির গান লিখতে জানে।
ফেসবুকের ভেতরবাক্সে দীপন ভাইয়ের সাথে হওয়া কথোপকথন পড়ছিলাম রাতভর। কত কথা তার সাথে, কত না বিষয়ে। কখনো কখনো খুব সাধারণ কথাবার্তার মধ্যেও যে তিনি নানা ইশারা, ইঙ্গিত দিয়েছেন - তা এখন কিছুটা বুঝতে পারছি হয়ত। এই যেমন গত জুলাইয়ে কথা হচ্ছিলো -
- কেমন আছেন ভাই?
- চলছে। শরীর ভালো না।
- জ্বর নাকি?
- না। ব্লাড সুগার অনেক বেশি
- ওহ, এটা'তো ভালো না। হাঁটাহাঁটি করেন? খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল?
- হয়ে ওঠে না। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে!
- তা’ও যত দিন আছেন সুস্থ থাকতে হবে’তো। তিনতলায় আপনার অফিস কত নম্বরে?
- ১৩১, একদম পেছনের সারিতে।
- হুমম, আইসা পরুমনে।
- অবশ্যই।
সেই কবে, তিন মাস আগে বলেছিলাম যাওয়ার কথা। কিন্তু নাহ, তার নতুন অফিসে আর যাওয়া হয়নি। হবে হয়ত কখনো। কিন্তু তার সেই সদাহাস্যজ্জল মুখটা আর দেখা হবে না। তবুও মনের সাহস বাড়াতে তার সেই কথাই ফের নিজেকে বলছি আজ; বলছি সমমনা সহযোদ্ধাদেরও - ‘ভয় পেও না, তবে সাবধান থেকো।’
কতিপয় সংবাদের সংযোগঃ
> তিনজনকে কুপিয়ে দরজায় তালা দিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা
> স্বজনেরা উদ্ভ্রান্ত
> সরকার হতভম্ব
> দরজা খুলে বাবা দেখলেন ছেলের রক্তাক্ত দেহ
> ‘আমি কোনো বিচার চাই না’