Powered By Blogger

০৩ নভেম্বর ২০১৭

কতটা স্বাধীন হয়েছে বিচার বিভাগ?

মাত্র দুই দিন আগে বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার এক দশক পূর্তি হয়েছে। ২০০৭ সালের পহেলা নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা হয় বিচার বিভাগ। ওইদিন সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধি কার্যকরের মাধ্যমে এই পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে আজও বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সম্প্রতি এ নিয়ে আলোচনা বাড়িয়েছে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ও নির্বাহী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক দল আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য বাহাস। সংবিধান ও আইন বিষয় সাংবাদিকরা বলছেন, এটা কারো জন্যই ভালো হচ্ছে না। 

১/১১-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঠিক আগের দিন ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত চারটি বিধিমালা সাত দিনের মধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। যদিও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাবিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (পে-কমিশন) বিধিমালা সংক্রান্ত মামলা তখনও বিচারাধীন। পরদিন ক্ষমতা দখল করেই বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার ঘোষণা দেয় সেনা সমর্থিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর ১৬ জানুয়ারি তারা ওই বিধিমালা চারটি জারি করে। এগুলো বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগের সরকারের তৈরি করা বিধিগুলো বিলুপ্ত হবে বলে বিধান রাখা হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ ১৭ জানুয়ারি ২০০৭ দিনের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজ শুরু করেন। উপদেষ্টা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদনের পর ২৯ অক্টোবর ২০০৭ ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে ১৮ অক্টোবর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিন ও সরকারের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার জন্যে ১ নভেম্বর তারিখ ঘোষণা করেন। এরপর ৩১ অক্টোবর পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ তার সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। 
তবে দশ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও পুরোপুরি স্বাধীন হতে পারেনি বিচারবিভাগ। এতগুলো বছরেও চূড়ান্ত করা যায়নি উল্লেখিত বিধিমালাগুলো। এ নিয়ে সংক্রান্ত মামলা এখনও বিচারাধীন। বিচার ও নির্বাহী বিভাগের বিরোধীতাও অব্যাহত রয়েছে। কিছুদিন আগেও বিচারপতি এসকে সিনহা প্রকাশ্য সভায় বলেছেন, ‘সব সরকারই বিচারবিভাগের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। প্রশাসন কখনো চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক।’ এরই প্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘কোনো দেশে বিচারপতিরা বিচার কার্য্যরে বাইরে এত কথা বলেন না।’ এ নিয়ে দফায় দফায় বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়েছে বিচার ও নির্বাহী বিভাগ। 
অন্যদিকে আইন বিভাগের সাথেও সম্পর্ক ভালো নেই বিচার বিভাগের। গত এক দশকের দুই বার সংবিধান সংশোধন করেছে জাতীয় সংসদ। প্রস্তাবনা সংশোধন, ১৯৭২-এর মূলনীতি পূনর্বহাল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, ১/১১ পরবর্তী দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৯০ দিনের অধিক ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি ‘প্রমার্জ্জনা’, নারীদের জন্য সংসদে ৫০ টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আরো বেশ কিছু পরিবর্তন এনে ২০১১ সালের জুনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নবম সংসদ। এর আগে সংসদের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ কমিটি করে সংবিধান বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মতামত নেয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতিদের সাথেও এক বৈঠক করেছিলো ওই কমিটি। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও টিকেছিলো জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তৈরী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আমলের চতুর্থ সংশোধনীতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে নেয়া হয়। এরপর জিয়াউর রহমান এসে তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত করেন। 

এদিকে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ জন সংসদ নিয়ে যাত্রা শুরু করা দশম সংসদ সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনে। এতে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চলতি বছরের জুলাইয়ে এই সংশোধনী বাতিল করে দেয় উচ্চ আদালত। এ বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ রায়ে বর্তমান সংসদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলে পর বিচার, নির্বাহী ও আইন বিভাগের দ্বন্দ্ব চরমাকার ধারণ করে। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ ঘোষণা, তার ছুটির আবেদন, বিদেশ গমন, দুর্নিতীর অভিযোগসহ সরকার ও তার পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সরগরম হয়ে আছে পরিস্থিতি। এ ব্যাপারে কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার সম্প্রতি লিখেছেন, ‘এবারের বিতর্কে যদি বিচার বিভাগের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়, তাহলে নির্বাহী বিভাগের ক্রেডিবিলিটিও নষ্ট হবে, তাহলে আইন বিভাগের ক্রেডিবিলিটিও রক্ষা পাবে না। বিচার বিভাগের মর্যাদা যতটা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, তা উদ্ধারে বহু যুগ লাগবে।’ এনিয়ে আলাপকালে আইন বিষয়ক সাংবাদিক মিল্টন আনোয়ারও তার সাথে একমত পোষন করেনভ। তিনি বলেন, ‘দুই পক্ষই ভুল করছে।’
একাত্তর টিভির এই সিনিয়র রিপোর্টার আরো বলেন, ‘গত ১০ বছরে তেমন কিছুই আগায় নাই। বিচার বিভাগের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আগের মতোই আছে। স্বতন্ত্র নিয়োগ সংস্থা হলেও উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ এখনো রাজনৈতিক বিবেচানাই হয়। সুপ্রিম কোর্টও পুরোপুরিভাবে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণভার পায়নি। বিচারকদের চাকুরিবিধি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বরং এখন একটা দ্বৈত ব্যবস্থা চলছে। মাজদার হোসেন মামলা আসলে শেষই হয়নি আজও।’ মিল্টন আনোয়ার বলেন, ‘বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হলে স্বাধীন প্রসিকিউটর লাগবে, স্বাধীন সচিবালয় লাগবে, স্বাধীন তদন্ত সংস্থাও লাগবে। এসব বাদ দিয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীন হয় না।
মিল্টন আরো বলেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলী ও পদায়ন এখনো কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বলা হয় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরমর্শক্রমে করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আসলে তা করেন সরকারের ইচ্ছায়। সুপ্রিম কোর্ট এখনো আর্থিকভাবেও স্বাধীন হয়নি। এ বছর বাজেটে সুপ্রিম কোর্টের বরাদ্দ এক টাকাও বাড়েনি।’ ক্ষমতাসীনরা যতদিন দুবৃত্তায়ন বন্ধ না করবে ততদিন উত্তরণের পথ নাই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মিল্টনের সাথে সহমত পোষন করেছেন প্রায় ২৩ বছর ধরে সংবিধান ও আইন বিষয়ে সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকা সাইদ আহমেদ। 
বাংলাদেশের খবর-এর এই প্রধান প্রতিবেদক বলেন, ‘কাগজকলমে স্বাদীন হয়েছে বিচারবিভাগ। সরকার আদতে তার নিয়ন্ত্রণ কমায়নি। বিএনপি আমলে যারা এই মাজদার হোসেন মামলার রায় কার্যকরের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, আওয়ামী লীগের আমলে তারা আইনমন্ত্রী হয়ে আবার এর বিরোধিতা করেছেন। পুরো বিষয়টি আসলে রাজনৈতিক হয়ে গেছে।’ সাইদ আহমেদ আরো বলেন, ‘বিচারের সাথে নির্বাহী ও আইন বিভাগের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বটা মূলত স্বার্থের সংঘাত। সদিচ্ছা থাকলে এ সংকট কাটতে বেশী সময় লাগার কোনো কারণ নেই। সংবিধানেই সব সমাধান রয়েছে। 
১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ ধারায় বলা ছিলো ‘রাষ্ট্র নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করবে’। কিন্তু স্বাধীন বিচার বিভাগ পেতে দেশকে অপেক্ষা করতে হয়ে আরো কয়েক দশক। ১৯৮৯ সালে সরকার বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কিছু পদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করা হলে অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দেয়। সরকার এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য ১৯৯৪ সালের ৮ জানুয়ারি জজ আদালতের বেতন স্কেল বাড়িয়ে দেয়। তবে প্রশাসন ক্যাডারের আপত্তির মুখে ওই বর্ধিত বেতন স্কেল স্থগিত করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাজদার হোসেনসহ ৪৪১ জন বিচারক ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট পাঁচ দফা সুপারিশসহ ওই মামলার রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ১৯৯৯ সালে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পরবর্তী বিএনপি সরকার এই রায় বাস্তবায়নের জন্য বারবার সময় নিতে থাকে। তাই আওয়ামী লীগ তাদের প্রায় দেড় বছর সময়ে ও বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট পাঁচ বছর সময়ে রায় বাস্তবায়নে সেভাবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

* মূল লেখাটি বাংলাদেশের খবর পত্রিকায় গত ১ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি আগামী ডিসেম্বরে বাজারে আসার কথা রয়েছে।
newsreel [সংবাদচিত্র]