Powered By Blogger

০৮ জুলাই ২০১৫

সর্বোচ্চ সংকর জাতের সঙ্কট

© eon's photography
কালান্তরের বিভিন্ন গণিতে নিম্ন মধ্যম আয়ের জনপদে পরিণত হওয়া বাঙালের এই দেশে নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা যে কারো কোনো সুতীব্র ইচ্ছেই তার বাঁচার ইচ্ছে নাই করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এমন আত্মোপলব্ধিতে দাঁড়িয়ে আজও এ জাতির অজস্র মানুষ বিশ্বাস করে, “অযোগ্যরাই এভাবে ভাবে। যোগ্যদের স্বপ্ন যে কোনো অবস্থায় বাঁচে, এবঙ তারা বাঁচায় আরো অজস্রের স্বপ্ন। দুরন্ত পতনে নৈরাশ্যের সুতীক্ষ্ণ খাদের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতেও তারা ঘুরে উড়ে বেড়িয়ে যেতে পারে।” কারণ তাদের অনার্য খুনে থাকা অনিবার্য স্বাধীনতার সুপ্ত তৃষ্ণা কখনোই মরে না। বরঙ হাজার বছর ধরে বিপরীত স্রোত ডিঙানোয় তারাই যে শ্রেষ্ঠ। যদিও এই জাতির কখনো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনাকাঙ্খা ছিলো না।
বেথেলহামে জ্ঞানী যীশু জন্মের দু’হাজার পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে। মহাজ্ঞানী মোহম্মদ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন, তা’ও চৌদ্দশ ছত্রিশ বছর আগে। এসবেরও প্রায় অর্ধলক্ষ বছর আগে সভ্য জ্ঞানচর্চায় অভ্যস্ত হওয়া একটি জাতির নাম ‘বাঙাল’। গঙ্গা অবববাহিকার উর্বর নদীমাতৃক সমতলে বসবাসকারী এই জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই পুরানো। আদি প্রাচুর্যতা ও প্রাণখোলা ঔদার্যের সুবাদেই সম্ভবত তারা আজকের দুনিয়ায় ‘সর্বোচ্চ সংকরায়িত মনুষ্য জাত’। পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বেশী বৈচিত্রপূর্ণ চিন্তা, চেতনা, রঙ, আকৃতির ‘হোমো সেপিয়েন্স’ সমৃদ্ধ একটি ভাষাগোষ্ঠী পাওয়া যাবে কি’না, সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদের ভাষা বাঙলাও নিঃসন্দেহে বিদ্যমান দুনিয়াবী ভাষাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংকরায়িত এবঙ জীবিত। যে কোনো ভাষার শব্দকে অনায়াসে আত্মীকরণে বাঙালরা ওস্তাদ।
© eon's photography
এমন পরাক্রমশালী ভাষাজ্ঞান থাকা সত্ত্বেও এ জাতকে বরাবরই পর্যুদস্ত করেছে কূটনীতিচর্চার অনীহা। সম্ভবত জাতির কোনো কৌমের জ্ঞানেই কখনো বিভেদের প্রবণতা সমাদৃত ছিলো না। হয়ত তাদের সমাজে পরিত্যাজ্য ছিলো না কেউই। যে কারণেই তারা অতিথিকে পরিবারের সদস্যদের মতোই আপন করে নিতে পারতো। চাহিদার ক্ষেত্রেও তারা বরাবরই অল্পতে তুষ্ট। যারই জেরে আজও অধিকারের প্রশ্নের দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখতেই ভালোবাসে নির্ভেজাল শান্তি প্রিয় এই জাতির মানুষগুলো। সংঘাতের চেয়ে সমঝোতাই তাদের অধিক পছন্দ।
যে কথা বলছিলাম; বাঙালের জনপদে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটাই বহিরাগত। সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য বিস্তারের লুটেরা ঘোড়ায় সাওয়ার করে আগত বহিরাগতরা নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার স্বার্থেই বিভেদের এই মন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এখানে। এক্ষেত্রে তাদের প্রিয় ও প্রধান হাতিয়ার ছিলো ধর্ম। কারণ তারা দেখেছিলো দুর্নিবার সাহসী আর একগুয়ে এই জাতি কোনো অস্ত্র নয়, কেবল জ্ঞানের সামনেই নতজানু হয়।
আর্যরা আসার আগে বাঙালের চরিত্র কতটা সহজ সরল ছিলো তা এ দেশের সাধারণ কৃষক, মাঝি, জেলে, কুমার, কামার, ছুতার, করাতী বা শীলদের মতো ‘কথিত’ নিম্নবর্গের পেশাজীবি সম্প্রদায়গুলোর জীবনপ্রণালী নিবিড়ভাবে খেয়াল করলে আজও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে হয়ত। দেখবেন এরা কর্মঠ, সাহসী, কৌতূহলীও। তবে কারো বিরক্তি বা ক্ষতির কারণ হবে না। হয়ত প্রত্যেকটি মানুষ যে প্রত্যেকের জন্য কত প্রয়োজনীয় তা’ও ওরা হাজার বছর আগেই জেনেছে। আর তাদের সমাজে গিয়ে মিশলেই বুঝবেন তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জ্ঞানকে আজও কতটা কদর করে।

© eon's photography
অবস্থাদৃষ্টে এটা সহজেই বোধগম্য যে, সংকরায়িত বাঙালরা পারস্পারিক আস্থাহীনতায় বড় জড় আর ভীত এক জাতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের মনন বিভ্রান্ত। এমন ভাবনার পরম্পরাতেই একদিন মনে হয়েছে বাঙাল অধ্যুষিত এই জনপদ বেশ বুঝে শুনেই ভিনজাতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অধীনতা মেনেছে বহুবার। অর্থাৎ বার বার তারা স্বেচ্ছায় পরাধীন হয়েছে। এই যেমন আজও তাদের দেশ চলছে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র আর দাতাসংস্থা নামধারী ভিনদেশী একাধিক শাসকগোষ্ঠীর ইশারায়। অবস্থানগত কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ আজ এসব জেনেও উদাস। যদিও এটা দুঃখজনক যে প্রজন্মান্তরে ওই জানার বা বোঝার ইচ্ছেটুকুও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
সংকরায়ন পরবর্তী ইতিহাস বলে বাঙালের পক্ষে কেউ রুখে দাঁড়ালে বৈদেশিক চালে স্ব-জাতের হাতেই তার মৃত্যু অবধারিত। তবুও আমি বিশ্বাস করি বিবর্তন আসন্ন। কারণ বাঙাল বড় কঠিন জাত, প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট। তাদের ‘দাবায়া রাখা’ বড়ই কঠিন।  দীর্ঘ পরাধীনতা তাদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমৃদ্ধও কম করেনি। এই সমৃদ্ধির সুফল হয়ত অবাঙাল কেউ কেউও আন্দাজ করতে পারছেন। 
সংকরায়িত বাঙাল জাতির ‘প্রত্যক্ষ’ স্বাধীনতার পরিপক্কতা আরেকটু বাড়ুক। তাদের রাষ্ট্রের বয়স অন্তত পঞ্চাশ, একশ বছর হোক। ততদিনে তাদের নতুন গণিতের প্যাঁচে না পরার কৌশল শেখা হয়ে যাবে। তখনই দেখবেন তাদের পাস্পরিক আস্থাহীনতাও কাটতে শুরু করবে। ক্রমে দুর্বল হতে থাকবে ‘বিভেদ জিইয়ে সুবিধা আদায়ে পটু ভিনদেশী’ পরোক্ষ শাসকগোষ্ঠী । এক সময় তারা আর ভাত পাবে না। অমুক বাদ, তমুক পন্থা বা পাপ, পুণ্যের দোহাই দিয়ে বাঙালকে আলাদা করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে
© eon's photography
সেই বিভেদহীন প্রজন্মের অপেক্ষায় আজকের বাঙালরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? সে উপায় নেই কিন্তু। কাঙ্খিত সেই প্রজন্মের জন্য পথ তৈরীর দায়িত্ব নিতে বোধসম্পন্ন প্রত্যেককে। পথটা যত দ্রুত তৈরী হবে, ততই তরান্বিত হবে তাদের আগমন কাল। সতীর্থ অগ্রজ রাসেল আহমেদের কথায়ও সমভাবনার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। স্বাধীন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা কোথায় যেন লিখেছেন - “একরোখা দামাল বাঙাল প্রাণই ডেকে নিয়ে আসবে সোনালী আগামী।” অর্থাৎ আগামী পৃথিবীর মুক্তি বাঙালেরই হাতে। একদিন বাঙালই ঘুচিয়ে দেবে সব বিভেদ, সীমানা। খাকবে না কোনো শোষণমন্ত্র,  জাগবেই সারা বিশ্ব। 
আর হ্যাঁ, বাঙাল কখনো সাম্রাজ্যবাদী হবে না, হতে পারবে না।
newsreel [সংবাদচিত্র]