Powered By Blogger
Chaka লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Chaka লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

২৭ মে ২০১৫

চাকা শিল্প বা দুই শিল্পীর গল্প

চাকা শিল্পী আবুল কাশেমে (৭০)
আবুল কাশেমের বয়স ৭০, আর আবুল হোসেনের ৬৪। পেশীবহুল পেটানো শরীরে তাদের পরিশ্রমের সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা সুষ্পষ্ট। পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রাখতে সেই আট বা নয় বছর বয়স থেকে তারা হাতুড়, বাটালি আর বাবলা কাঠের সাথে জড়িয়ে নিয়েছেন নিজেদের জীবন। প্রথম জন ৬২, আর পরের জন প্রায় ৫৫ বছর ধরে কাঠের চাকা তৈরীর কাজ করছেন। নিজ নিজ পিতার কাছ থেকেই কাজ শিখেছেন পাশাপাশি গ্রাম কালী চকভবানীপুর ও পাড়কৃষ্ণ গোবিন্দপুরের এই দুই চাকা শিল্পী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার সীমন্তবর্তী ওই এলাকাটি শত শত বছর ধরে চাকা শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। প্রায় নয় মাস আগে গিয়েছিলাম ওখানে, মূলত অন্য এক কাজে। কিন্তু চাকা শিল্পীদের সাক্ষাত পেয়ে আলাপের লোভ সামলাতে পারিনি। তাদের ছবি তোলার অনুমতিও মিলেছিলো সহজে। আহা, কী অদ্ভুত সহজ মানুষ তারা!

‘কাঠমিস্ত্রী আর চাকা শিল্পী এক নয়। কাঠের কাজ জানলেই চাকা বানানো যায় না’ – কাজ করতে করতেই বলছিলেন আবুল কাশেম। তার এ বক্তব্যে জড়িয়ে আছে শিল্পের গৌরব। যদিও তিনি জানেন, সেই দিন আর বেশি দূরে না যেদিন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের গাড়ি শুধু জাদুঘরেই দেখা যাবে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবে সুপ্রাচীন এসব দেশী বাহন। তাই’তো তিনিও বলেছেন, ‘আর কিছু দিন পর হারিয়ে যাবেন চাকার কারিগররাও।কাশেমের নয় সন্তানের মধ্যে চার জন ছেলে। তাদের কেউই চাকা শিল্পী হতে চায়নি কখনো। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘হয়ত বেশী খাঁটুনিতে কম পয়সা দেখে ওরা এ কাজ করতে চায় না।’ জানা গেছে, তার ছেলেরা রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন।

এদিকে, আবুল হোসেনেরও চার ছেলে। তারাও কেউ চাকা শিল্পের প্রতি আগ্রহী নন। একজন অবশ্য বাবার সাথে থেকে কাজ শিখেছিলেন। সে আবার বিদেশে চলে গেছে। হোসেনের দেয়া তথ্যানুযায়ী, একটি চাকা বানাতে কমপক্ষে তিন দিন থেকে পাঁচ দিন সময় লাগে। এর আগে বাবলা গাছের কাঠ চেরাই করে এক মাস রোদে শুকিয়ে কাজের উপযোগী করতে হয়। আর একটি চাকা তৈরীতে বর্তমান (২০১৪ সালের আগস্টের) বাজার দর অনুযায়ী ১৬’শ টাকার বাবলা কাঠ লাগে। প্রতিটি চাকা বিক্রি হয় ২৮’শ থেকে তিন হাজার টাকায়। এক একটি চাকা প্রায় ১০ বছর গাড়িতে চলার জন্য উপযুক্ত থাকে।
আবুল কাশেম, আবুল হোসেনসহ দু’জনার গ্রামের আরো একাধিক চাকা শিল্পী জানান, তাদের এলাকায় এখনো কমপক্ষে দেড়শ চাকা শিল্পী আছেন। বারো মাস ধরেই চাকা তৈরির কাজ চলে। তবে এই শিল্পীদের সকলের বয়সই পঞ্চাশোর্ধ্ব। অতএব আগামী পঞ্চাশ বছর পর সম্ভবত এদের একজনও থাকবেন না। বিলুপ্ত হবে ওই এলাকার চাকা শিল্পও। দেশের অন্যান্য এলাকার চিত্রও বোধকরি খুব বেশী আলাদা হবে না। কারণ, চাকা শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কাঠের চাকার উপযোগিতা কমার বিষয়টি অনেক আগেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছে।
চাকা শিল্পী আবুল হোসেন (৬৪)
ফিরে দেখা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে ধরা হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে চাকা আবিষ্কৃত হয়। শুরুতে কুমোরদের কাজে এটির ব্যবহার ছিলো। ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে। চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়। তবে বারবিয়েরি-লো (২০০০) এর মতে আরো পূর্বে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন সভ্যতায় চাকার ব্যবহার দেখা যায়না। তবে অলমেক ও অন্যান্য কিছু আমেরিকার সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যে শিশুদের খেলনা হিসাবে চাকাযুক্ত গাড়ি পাওয়া গেছে। প্রায় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এসব খেলনাতে চাকার ব্যবহার থাকলেও আমেরিকার সভ্যতাগুলোতে যানবাহনের যন্ত্রাংশ হিসাবে চাকার প্রচলন ছিলো না। প্রাচীন নুবিয়াতে চাকা ব্যবহার করা হতো মাটির হাড়ি ও পাত্র তৈরীতে, এবং পানি উত্তোলনে। নুবিয়ার পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত চাকাগুলো ঘুরানো হতো গবাদিপশু দিয়ে। নুবিয়ার অধিবাসীরা মিশর থেকে আনা অশ্বচালিত রথ ব্যবহার করতো।
চাকা ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত সমতল বা মসৃন রাস্তা না থাকায় চাকার প্রচলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। যেসব এলাকায় রাস্তা ছিলোনা এবং অসমতল ভূমির উপর দিয়ে চলতে হয়েছে, সেসব এলাকায় চাকা-যুক্ত যানবাহনের বদলে মানুষের কিংবা পশুর পিঠে করে মাল বহন করা হতো। এমনকি বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বের অনুন্নত এলাকাগুলোতে ভালো রাস্তাঘাটের অভাবে চাকাযুক্ত যানবাহনের ব্যবহার কম ছিলো।
শুরুতে চাকা নির্মাণ করা হতো কাঠের চাকতি দিয়ে, যার কেন্দ্রে অক্ষদণ্ডের জন্য একটি গর্ত করা হতো। স্পোকযুক্ত চাকা অনেক পরে উদ্ভাবিত হয়। এই রকমের চাকার ব্যবহার গাড়ির ওজন কমিয়ে আনে, যার ফলে দ্রুতগতির বাহন তৈরি করা সম্ভব হয়। প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের সমকালীন আন্দ্রোনভ সংস্কৃতিতে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার পাওয়া যায়। এর অল্প পড়েই ককসশাস এলাকার অধিবাসীরা অশ্বচালিত বাহনে স্পোকযুক্ত চাকা ব্যবহার করে। মূলত যুদ্ধে ব্যবহৃত রথে এধরণের চাকা তারা ব্যবহার করতো। এখান থেকে স্পোকযুক্ত চাকার ব্যবহার গ্রিক উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। চাকাযুক্ত বাহনের ব্যবহার গ্রিক সভ্যতার বিকাশে সহায়তা করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দ নাগাদ কেল্টিকদের রথগুলোতে এমন চাকা ব্যবহার করা যেতো, যার পরিধি বরাবর লোহার বেষ্টনি দেয়া থাকতো। ফলে এ ধরণের চাকাগুলো অনেক মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হতো। স্পোকযুক্ত চাকা এভাবেই প্রায় অপরিবপর্তিত অবস্থাতে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্যবহৃত হয়ে আসে। ১৮৭০ খ্রিঃ এর দিকে চাকায় নিউম্যাটিক টায়ার ব্যবহার করা শুরু হয়।
আনুমানিক ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের প্রাচীন যুদ্ধপতাকায় চাকাবিশিষ্ট গাড়ির ছবি - উইকিপিডিয়া
সামগ্রিক ভাবে চাকার আবিষ্কার কেবল পরিবহন ব্যবস্থাই নয়, বরং প্রযুক্তির নানা দিকে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চাকা ব্যবহার করে জল চক্র (পানি তোলার এবং পানি হতে শক্তি আহরণের চাকা), গিয়ার চাকা, চরকা, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিক কালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ, এবং টারবাইন—এর সবই চাকারই পরিবর্তিত রূপ।
newsreel [সংবাদচিত্র]